বৃহস্পতিবার, ২২শে মে, ২০২৫
৮ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২

তিন হাজার কোটি টাকা হাতিয়েছে ‘আফসার গ্রুপ’

আফসার গ্রুপ

অনলাইন ডেস্ক:

বেতনভুক্ত কর্মচারীদের ‘মালিক’ বানিয়ে এক্সিম ব্যাংকসহ বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে অন্তত ৩ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে ‘আফসার গ্রুপ’ নামক একটি প্রতিষ্ঠান। ঋণের নামে লোপাটকৃত অর্থ প্রায় পুরোটাই পাচার করেন কানাডা।

‘আইটি সার্ভিস’ ব্যবসার নামে জয়েন্ট স্টক কোম্পানি থেকে রেজিস্ট্রেশন নিয়ে তৈরি করা হয়েছে বেশকিছু কাগুজে প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানের বেতনভুক্ত কর্মচারীদের নামে খোলা হয় এসব কোম্পানি। কথিত এসব কোম্পানির নামে ঋণ নেয়া হলেও যাদের নামে কোম্পানি খোলা হয়েছে তাদের অনেকে কিছুই জানতেন না। ঋণের দায় মাথায় নিয়ে বিনিদ্র রাত যাপন করলেও প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান কর্ণধার সোমা নাসরীনের ভয়ে মুখ খুলতে পারছেন না কেউ। তথ্য নির্ভরযোগ্য সূত্রের।

সূত্রটি জানায়, আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্টতা, প্রধানমন্ত্রীর বিজ্ঞান ও তথ্য-প্রযুক্তি উপদেষ্টা হাসিনাপুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের আশীর্বাদপুষ্ট কথিত এ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান সোমা নাসরীন। তার মরহুম স্বামী খন্দকার নূরুল আফসার ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তাদের এসোসিয়েশন-রাওয়া ক্লাবের চেয়ারম্যান। এই পরিচয় ব্যবহার করে তিনি এক্সিম ব্যাংকসহ বেশকিছু নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক পদ কেনেন। আর এ পদের জোরেই তিনি লোপাট করেন ব্যাংকে গ্রাহকের গচ্ছিত অর্থ। এ জন্য ধার ধারেননি কোনো নিয়ম-কানুন। ঋণের বিপরীতে দেননি পর্যাপ্ত জামানত। কাগুজে ‘আইটি বিজনেস’ দেখিয়ে নেয়া হয় হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ।

সূত্র মতে, ‘আফসার গ্রুপ’র চেয়ারম্যান সোমা নাসরীনের স্বামী খন্দকার নূরুল আলম ছিলেন সাবেক সেনা কর্মকর্তা। তিনি মাত্র ১৩ বছর সামরিক বাহিনীতে কর্মরত ছিলেন। জীবনের বেশিরভাগ সময় বেসামরিক বিষয় নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও পরিচয়টা প্রচার করেন ‘অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা’ হিসেবে। ধারণ করেন বর্ণচোরা রূপ। ‘ভালো’র মুখোশে ‘মন্দ’ আড়াল করে তিনি নিজেকে উন্নীত করেন ‘সুশীল’র কাতারে।

এর আগে খন্দকার নূরুল আফসার অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের ১০ নম্বর জোনের ‘জোনাল এক্সিকিউটিভ অফিসার’ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সেখানে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ ছিলো। দুর্নীতিলব্ধ ওই অর্থ দিয়ে তিনি পরবর্তীতে এক্সিম ব্যাংকের পরিচালক পদ ক্রয় করেন বলে জানায় সূত্রটি। তার মৃত্যুর পর ‘আফসার গ্রুপ’র চেয়ারম্যান এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে বসেন স্ত্রী সোমা নাসরীন। মরহুম স্বামীর নামকে পুঁজি করে তিনিও অব্যাহ রাখেন ব্যাংক ঋণের নামে অর্থ লোপাট ও পাচার।

অর্থনৈতিক দুর্র্বৃত্তপনাকে আড়াল করতে তিনিই বিভিন্ন শিক্ষা, সামাজিক ও সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত হন। মহত্ত্ব কীর্তন করে বিভিন্নজনকে দিয়ে নিজের পক্ষে আর্টিকেল লেখান। খন্দকার নূরুল আফসার সম্পর্কীয় প্রচার-প্রপাগাণ্ডায় নিজেকে একজন ‘চৌকস’, ‘সাহসী’ সাবেক সেনা কর্মকর্তা, সমাজসেবক, মানব দরদী’ হিসেবে জাহির করা হয়। মূলত এসবই ছিলো তার মুখোশ। নিজের অর্থনৈতিক দুর্বৃত্তপনাকে আড়াল করতেই তিনি এমন মুখোশ ধারণ করেন। ‘মানবতার ফেরিওয়ালা’র পরিচয়ের আড়ালে তিনি ছিলেন আপাদমস্তক একজন ব্যাংক লুটেরা। একাধারে তিনি ছিলেন এক্সিম ব্যাংকের পরিচালক। বেশ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িয়ে বাগিয়ে নিয়েছেন ‘শিক্ষানুরাগী’র তকমা। অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তাদের এসোসিয়েশন-রাওয়া ক্লাবের তিনি ছিলেন চেয়ারম্যান ছিলেন নূরুল আফসার। এই পরিচয় এবং প্রভাব কাজে লাগিয়ে গড়ে তুলেছেন বিপুল সম্পদ-সাম্রাজ্য। জয়েন্ট স্টক থেকে রেজিস্ট্রেশন নিয়েছেন অন্তত ১০টি প্রতিষ্ঠান। স্ত্রী-সন্তানদের ভবিষ্যৎ জীবন নিশ্চিত করতে ব্যাংক ঋণলব্ধ প্রায় সব অর্থই তিনি সরিয়ে নেন কানাডা। যদিও এই সম্পদ তিনি ভোগ করে যেতে পারেননি। ২০২২ সালের ৫ সেপ্টেম্বর ৬৮ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন খন্দকার নূরুল আফসার। এখনো তার নামের ওপর চালু রয়েছে ‘এমজিএইচ’ নামের সংস্থা। এই সংস্থার ব্যানারে গরিব মেধাবী ছাত্রীদের আর্থিক সহায়তা দেয়া হয়। তবে অভিযোগ রয়েছে, সহায়তার নাম করে ৮ বছরে ‘আনোয়ারা মান্নাফ গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজ’ তহবিল থেকে সোমা নাসরীন আত্মসাৎ করেন ৭৫ লাখ টাকা।

সম্প্রতি রাজধানীস্থ তার অফিস (বাড়ি নং-৩৯২, রোড-২৯,নিউ ডিওএইচএস, ঢাকা) পরিদর্শনে গিয়ে দেখা যায়, দফতরে প্রাণ চাঞ্চল্য নেই। বাড়ি-৩৪৭, রোড-২৫, নিউ ডিওএইচএস, মহাখালি, ঢাকা-এর বাসার ঠিকানায় খোঁজ নিতে গেলে জানানো হয়, সোম নাসরীন ম্যাম বাসায় নেই।

জানা গেছে, ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর ব্যাংক ঋণের মাধ্যতে বিপুল অর্থ আত্মসাতকারী আফসার পরিবার সদস্যরা আত্মগোপনে চলে যান। কারণ, প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান কর্ণধার সোমা নাসরীনের বিরুদ্ধে রয়েছে জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে যেনতেন প্রকারে আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ। তিনি নিজ অফিসের অন্তত ১৭ জন কর্মচারীর নামে এক্সিম ব্যাংক থেকে শত শত কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন। ঋণ নেয়ার আগে বেতনভুক্ত কর্মচারীদেরকে বিভিন্ন কাগুজে প্রতিষ্ঠানের ‘ব্যবস্থাপনা পরিচালক’ দেখানো হয়। প্রতিষ্ঠানগুলোর বাস্তবিক কোনো অস্তিত্ব নেই। আ’লীগ সরকার উৎখাত হওয়ার পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যখন আর্থিক খাতে সংস্কার ও শৃঙ্খলা ফিরে আনার কাজে হাত দিয়েছেন তখন আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন এসব ভুয়া প্রতিষ্ঠানের ‘মালিক’গণ। সোমা নাসরীনের জিম্মিদশায় থেকে বিভিন্ন ডকুমেন্টে স্বাক্ষর দিয়েছিলেন তারা। এর মধ্যে রয়েছেন ছা-পোষা স্কুল শিক্ষকও।

সূত্রটি জানায়, যাদেরকে ভুয়া প্রতিষ্ঠানের মালিক বানিয়ে ঋণ নেয়া হয়েছে তাদের মধ্যে রয়েছেন, রাজধানীর উত্তরা ৫ নম্বর সেক্টরের রোড-৬/এ, দলিপাড়া ‘আনোয়ারা মান্নাফ গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজ’র শিক্ষক খন্দকার স্বপন। তিনি খন্দকার নূরুল আফসারের আত্মীয় বলে জানা গেছে। আফসার গ্রুপ তার নামে ঋণ নিয়েছে কিনা-জানতে চাইলে ফোন কেটে দেন।

এক্সিম ব্যাংক থেকে কয়েকশ’ কোটি টাকা ঋণ নেয়া হয়েছে আফসার গ্রুপের বর্তমান চেয়ারম্যান সোমা নাসরীনের পিএস হিসেবে কর্মরত খন্দকার নিছার আহমেদ। নিছার গুলশান হেড অফিস ও মহাখালিস্থ শাখা অফিসে বসেন। আফসার গ্রুপের আইটি ফার্মের প্রধান নির্বাহী সাজ্জাদ হোসেনের নামেও নিয়েছেন ব্যাংক ঋণ। গ্রপের ম্যানেজার শাহজাহান, মার্কেটিং ম্যানেজার কামাল হোসেন, অ্যাকাউট্যান্ট ছায়েদুর রহমানের নামে নিয়েছেন কয়েকশ’ কোটি টাকা ঋণ। কর্মচারী মো: ইয়ামিনের নামেও নিয়েছেন ঋণ। এভাবে নিজ প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নামে তিনি বেনামে ঋণ নিয়েছেন। সব অর্থ পাচার করে দেয়ায় ঋণের টাকা শোধ করছেন না।

সূত্র মতে, ‘সুহানা অ্যান্ড আনিস আহমেদ ফাউন্ডেশন’র নামে পরিচালিত ‘আনোয়ারা মান্নাফ গালর্স স্কুল অ্যান্ড কলেজ’ মূলত সোমা নাসরীনের অর্থ হাতানোর মেশিন। কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি এ প্রতিষ্ঠান থেকে। প্রতিষ্ঠানটির গভর্নিং বডিতে আসার পর স্কুলের অ্যাকাউন্ট থেকে নগদ নিয়েছেন ৭৫ লাখ টাকা। এছাড়া ৩টি গাড়ি বিক্রি করে প্রাপ্ত ৫০ লাখ টাকা পকেটস্থ করেন সোমা নাসরীন। আনোয়ারা মান্নাফ গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজের সম্পত্তি বন্ধক রেখে ব্যাংক থেকে ১৭ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন বলে বলে জানা গেছে। স্কুলের মালিকানায় থাকা ৫৭ শতাংশ জমি তিনি গোপনে ১০ বছরের জন্য লিজ দিয়েছেন। গত ২৭ জুন লিজ প্রদানের এ তথ্য ফাঁস হয়ে যায়। জালিয়াতি ও প্রতারণামূলকভাবে হাতিয়ে নেয়া শত শত কোটি টাকার গন্তব্য কানাডা। সেখানে তিনি গড়ে তুলেছেন ‘সেকেন্ড হোম’। এভাবে তিনি নানাভাবে প্রতিষ্ঠানটিতে আর্থিক সঙ্কট জিইয়ে রেখে অবৈধভাবে হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা।

তবে এসব তথ্য স্বীকার কিংবা অস্বীকার কোনোটিই না করে গতকাল শনিবার সোমা নাসরীন এ প্রতিবেদককে বলেন, আমি সাধারণ একজন গৃহিণী, ছা-পোষা মানুষ। এমনিতেই বিপদের মধ্যে আছি। আপনাকে কোনো তথ্যই দিতে পারবো না। আপনাদের কাছে যেসব তথ্য রয়েছে সেগুলোর সত্যতা কতটা রয়েছে খুঁজে দেখুন। এ বিষয়ে আমার কিছু বলার নেই।
তথ্য সূত্র- ইনকিলাব

মন্তব্য করুন